মহানায়ক একদিন রাইটার্স বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তাকে একঝলক দেখার জন্য রাইটার্সের ব্যালকনিতে ভীর উপচে পড়ছে। অনেকে আবার রাস্তায় নেমে এসেছেন। এমন সময় জ্যোতি বসু বললেন “এখানে ভিড় করছেন কেন, ভেতরে যান।“ একজন উত্তর দিলেন, আরে দাঁড়ান, উত্তম কুমারকে কি আর প্রতিদিন দেখতে পাওয়া যায়। হ্যাঁ, এরকমই ক্রেজ ছিল বাংলা সিনেমার, আর তিনি ছিলেন অরুণ চ্যাটার্জী ওরফে উত্তম কুমার।
মহানায়ক এর প্রথম দিকের অভিনয় জীবন সফল ছিল না। তাঁর একের পর এক ছবি ফ্লপ হয়েছে। এক সময় লোক কানাঘুষো ‘ফ্লপ মাস্টার’ নামেও ডাকতে শুরু করেছিলেন তাঁকে। কিন্তু তিনি একের পর এক কাজ করে গেছেন। সফল হয়েছেন, প্রশংসিত হয়েছেন। বাংলা হিন্দি মিলিয়ে তিনি প্রায় ৩৩ বছরের ২৫০ টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন যেগুলি আজ সিনেমা জগতের মূল্যবান সম্পদ। আজও বাঙালির হৃদয়ে তিনি অনেকখানি জায়গা দখল করে আছেন। নতুন প্রজন্ম তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। করবেনাই বা কেন, তার মত সাবলীল অভিনয় দক্ষতা খুব কম অভিনেতার মধ্যেই থাকে। ক্যামেরা তার কাছে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না।
তিনি নাম, যশ, খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল একদম অন্যরকম ভাবে। অভাব-অনটনের সংসার ছিল তাদের। গিরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের একটি বাড়িতে তাঁরা থাকতেন। অভাবের সংসারে তিনি নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি গানের শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। সেখানেই গানের ছাত্রী গৌরি দেবীর সঙ্গে তাঁর আলাপ পরিচয় হয়।
অভিনয় জীবনের বাইরে তিনি পরিবার-পরিজনদের নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান তিনি সহজে মিস করতে চাইতেন না। তাঁর কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে বা কোন পার্টিতে সকলের নেমন্তন্ন থাকত এবং তিনি আন্তরিকভাবে চাইতেন সেখানে সবাই উপস্থিত থাকুক। ভাই তরুণ কুমারের সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। দুজনে বেশ মজা করতেন। অমানুষ ছবির প্রিমিয়ার দেখে একমাত্র তরুণ কুমারই বলেছিলেন, “এ ছবি দারুন হিট হবে, কিন্তু তোর এটা অভিনয় হয়নি, মেলোড্রামা হয়ে গেছে।“
মহানায়ক বেশ ভোজন রসিক ছিলেন। তখন তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই ভবানীপুরের বাড়িতে চলে আসতেন মায়ের হাতের ভেটকি মাছের কাটাচচ্চড়ি খাওয়ার জন্য।
সত্যজিৎরায় উত্তম কুমার প্রসঙ্গে বলেছেন, “উত্তমের সঙ্গে আমি কাজ করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম আমার ২৫ বছরের ফিল্ম জীবনে তেমন খুব বেশি পায়নি। তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত। নিছক নির্দেশের বাইরে বিভিন্ন সুক্ষ ডিটেইল তিনি তাঁর অভিনয়ে যোগ করে দিতেন। যেগুলি তার সম্পূর্ণ নিজস্ব অবদান এবং তা কখনও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেত না। এখানেই একজন বড় অভিনেতার পরিচয়।“
সত্যজিৎ ‘নায়ক’ লিখেছিলেন উত্তম কুমারের কথা ভেবেই। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের এক অভিনয় পাগল যুবক সিনেমায় নেমে দ্রুত সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই চিত্রনাট্য শুনে উত্তম খুব খুশি হয়েছিলেন। কিছুদিন আগেই বসন্ত হওয়ার ফলে গালের দাগ তখনও সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু সত্যজিৎ সেভাবে মেকআপ ব্যবহার করতে দেননি। এই নায়ক ছবিতে মহানায়কের অভিনয় সবথেকে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আসলে অভিনয়ের দ্বারা দর্শক ধরে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। বক্সঅফিসে শুধুমাত্র তাঁর নামেই অর্ধেক টিকিট বিক্রি হয়ে যেত। তাই আজও বাঙালির কাছে সিনেমা জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র উত্তম কুমার।
—বিশেষ নিবন্ধ, লিখেছেন এম.শুভম