ভগৎ সিং ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী বিপ্লবী, যিনি দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে চিরকালের জন্য অমর হয়ে রয়েছেন আমাদের মধ্যে। সেই সময় দেশকে স্বাধীন করার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, ভগৎ সিং ছিলেন সেই মহান যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম (Bhagat Singh)। আজ আমরা তাঁর বিপ্লবী জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু অজানা তথ্য উপস্থাপন করছি, যা আমাদের দেশপ্রেমের আবেগকে অনুপ্রাণিত করে।
— সুকান্ত সাঁতরা
শৈশব জীবন (Bhagat Singh):
ভগৎ সিং জন্মগ্রহণ করেন ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯০৭ সালে পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বাঙ্গার নিকটস্থ খাতকর কালান গ্রামের এক শিখ পরিবারে। তার পিতার নাম সর্দার কিসান সিং সান্ধু ও মায়ের নাম বিদ্যাবতী। জানা যায় প্রথম থেকেই ভগত সিংয়ের পরিবার স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। তাঁর বাবা কিশান সিং এবং চাচা অজিত সিংহ গদার পার্টির সদস্য ছিলেন। তাঁর স্মরণে এই জেলার নাম পরিবর্তন করে এখন শহীদ ভগৎ সিং নগর করা হয়েছে (Bhagat Singh and Batukeshwar Dutt)। ভগৎ সিং দায়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, যেটি আর্য সমাজ (আধুনিক হিন্দু ধর্মের একটি সংস্কার সম্প্রদায়) দ্বারা পরিচালিত হত।
তারপর লাহোরের জাতীয় কলেজে ভর্তির জন্য স্কুলটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবং সেখান থেকেই ভগবতী চরণ ভার্মা, সুখদেব এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। তাঁর কৈশোরকালীন সময়ে দুটি ঘটনা দেশপ্রেমিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জাগ্রত করে তুলেছিল। এই দুটি ঘটনার প্রথমটি হল ১৯১৯ সালে জলিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা এবং দ্বিতীয়টি হল ১৯২১ সালে নানকানা সাহেবে নিরস্ত্র আকালি বিক্ষোভকারীদের হত্যা। যতদূর জানা যায় জলিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পরের দিন জালিয়ানওয়ালাবাগে গিয়ে পরিস্থিতি দেখেই তিনি মানসিকভাবে ব্রিটিশদের ভারত থেকে বহিষ্কার করার সংকল্প গ্রহন করেন।
বিপ্লবী জীবন:
সাল ১৯২১, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই সময়ে ভগৎ সিং (Bhagat Singh) মহাত্মা গান্ধীর উদ্যোগে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এবং তিনি ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে ব্রিটিশদের তুচ্ছ করতে শুরু করেন। ১৯২২ সালে গোরখপুরের চৌরি চৌরা ঘটনার জেরে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর এহেন সিদ্ধান্তে ভগৎ সিং ক্ষুব্ধ হন। এর পর মুহূর্তেই ভগৎ সিং মহত্মা গান্ধীর অহিংস পদক্ষেপ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে তরুণ বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এবং তিনি ভেবে নিয়েছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবই স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র কার্যকর উপায় হতে পারে।
বিপ্লবের প্রথম পাঠ:
এমন পরিস্থিতির মাঝে ভগৎ সিং-এর মা ও বাবা তাঁর বিয়ে দেবার জন্য পরিকল্পনা করছিলেন। তাঁর বিয়ের পরিকল্পনা হচ্ছে একথা জানার পরেই বিয়ে এড়ানোর জন্য তিনি কানপুরে পালিয়েছিলেন। এবং পরে বাবা-মা’র আশ্বাসের পরে তিনি লাহোরে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন, যে তাঁকে আর বিয়ে করার জন্য জোড় করা হবে না। এরপর থেকে তিনি গ্রামে থেকেই তাঁর সমস্ত রকম বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। ভগৎ সিং লাহোরে গিয়ে নিজ চেষ্টায় ‘নাউজওয়ান ভারত সভা’ নামে বিপ্লবী সংগঠন গঠন করেন। এরপরই তিনি ১৯২৮ সালে দিল্লির বিপ্লবীদের একটি সভায় যোগ দেন এবং সেখানে চন্দ্রশেখর আজাদের সংস্পর্শে আসেন।

তারা একত্রে হিন্দুস্তান সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র সমিতি গঠন করে। হিন্দুস্তান সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র সমিতির মূল লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ওই বছরই অর্থাৎ ১৯২৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ইংল্যান্ড থেকে ‘সাইমন কমিশন’ ভারত সফর করে। এই কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল- ভারতের মানুষের স্বায়ত্তশাসন এবং রাজতন্ত্রে অংশ নেওয়া। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এই কমিশনে কোনও ভারতীয় সদস্য ছিল না, যার কারণে সাইমন কমিশনের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
এই ঘটনার পরে লালা লাজপত রায় সর্বদলীয় মিছিলের নেতৃত্বে এবং সাইমন কমিশনের আগমনের প্রতিবাদে লাহোর রেলস্টেশনের দিকে যাত্রা করেন। এবং সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া শুরু করে, এই সময় বিক্ষোভকারীদের অগ্রগতি ব্যর্থ করতে পুলিশ নৃশংস লাঠিচার্জ করেছিল। এই নৃশংসভাবে লাঠিচার্জের ফলে গুরুতর আহত হয়ে মারা যান লালা লাজপত রায়। লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে, ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগীরা ভুলবশত দু জন ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর ভগৎ সিং-এর গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভবনা থাকায় দ্রুত লাহোর ত্যাগ করেন। তিনি নিজের দাড়ি কামিয়েছিলেন এবং চুল কেটে ছদ্মবেশ ধারন করেছিলেন।
কেন্দ্রীয় বিধানসভায় বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনা:
ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া আইন প্রণয়নের প্রতিক্রিয়ায়, হিন্দুস্তান সমাজতান্ত্রিক রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন বিধানসভা কেন্দ্রের ভিতরে একটি বোমা নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা করেছিল, এই কাজের পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল পাবলিক সেফটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এবং পরিকল্পনা মতই ১৯২৯ সালের ৮ ই এপ্রিল, ভগত সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত সমাবেশের করিডোরে একটি বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন, বোমাটি কাউকে হত্যা বা আহত করার উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করা হয়নি, তাই এটি জনশূন্য স্থানে ফেলা হয়েছিল, বোমা ছোঁড়ার পর গোটা সভাকক্ষ ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল। চাইলেই ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত পালাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’ বলে উচ্চস্বরে স্লোগান দিতে থাকেন তাঁরা। এই ঘটনার অল্প সময়ের মধ্যেই পুলিশ এসে উপস্থিত হয় এবং উভয়কেই গ্রেপ্তার করে।
লাহোর চক্রান্তের মামলা ও বিচার:
এই ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রথম দিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিলেও, গ্রেফতারের সময় ভগৎ সিং-এর কাছ থেকে পিস্তল পাওয়া যায়, এই কারনে ভগৎ সিং কে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এই ঘটনার পরই পুলিশ লাহোরে এইচএসআরএ বোমা কারখানায় অভিযান চালিয়ে যতীন্দ্র নাথ দাস, রাজগুরু ও সুখদেব সহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল, এছাড়াও ভগৎ সিংকে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা, সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট স্যান্ডার্স হত্যা এবং বোমা উত্পাদন করার সপক্ষে জড়ালো প্রমান আদালতে দেওয়া হয়। তবে নতুন মামলার শুনানি না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির আদেশ স্থগিত রাখা হয়।

এদিকে জেলখানায় ইউরোপীয় বন্দী ও দেশীয় বন্দীদের মধ্যে অসম ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউরোপীয় বন্দীরা নানা বিষয়ে সুবিধা পেলেও, ভারতীয় বন্দীরা সেভাবে সুবিধা পেত না। এই পার্থক্যের প্রতিবাদে ভগৎ সিং ও তাঁর সহ যোদ্ধারা অনির্দিষ্টকালের অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন সাথে সাথে ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। সরকার এই অনশন ভেঙে দিতে চাইলেও অসফল হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁর বাবা এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের অনুরোধে উপবাস ভেঙেছিলেন তিনি। এই শুনানি লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত।

ভগত সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসি:
এমন পরিস্থিতিতে সরকার দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা শুরু করে। ১৯৩০ সালে ৭ অক্টোবর তিনজন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালে ভগৎ সিং, রাজগুরু ও সুখদেব কে ফাঁসি দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। প্রিভি কাউন্সিলের কাছে তাঁদের প্রান ভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা হলেও তা খারিজ হয়ে যায়। ১৯৩১ সালে ২৩ মার্চ তিন বিপ্লবীকে লাহোর কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়।
ভগৎ সিং এখনও প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলেন। এই ২৩ বছর বয়সী বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর জীবনকাহিনী নিয়ে “শহীদ” (১৯৬৫) এবং “দ্য কিংবদন্তি অফ ভগত সিং” (২০০২) এর মতো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও ভগত সিংয়ের সাথে সম্পর্কিত “মোহে রং দে বাসন্তি চোল” এবং “সরফরোশি কি তামান্না” এর মতো জনপ্রিয় গানগুলি আজও বারবার ভারতবাসীর দেশপ্রেমের আবেগকে অনুপ্রাণিত করে তোলে।
— বিশেষ নিবন্ধ, আউটলাইন বাংলা