Outlinebangla: বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছি কাকে যেন একটা ভুতে ধরেছে। ঘড়িতে সকাল ৭ টা বাজে, তা বাজুক আমার কাছে কাক ভোর। কানে বালিশ চাপা দিয়ে একটু ঘুমনোর চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদের নিয়ম বেশিরভাগ জায়গাতেই খাটে না। বাড়ী, সে তো আর পৃথিবীর বাইরে নয়, কাজেই শব্দের মাত্রা সবসময় ৬৫ ডেসিবলের মধ্যে থাকবে এমন ভাবনা অহেতুক। (Schizophrenia in bengali) আর কি, উঠে পড়লাম।
মায়ের ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ যে দিদি আসে আমাদের বাড়িতে তার বাড়ীর একজনকে ভুতে ধরেছে, দ্যাওরের মেয়ে। যা বুঝলাম এতদিনে ভুত ছাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে তবে কিছুতেই লাভ তেমন হচ্ছে না ওদিকে ভুত নাকি বেঁকে বসেছে, বলেছে এখন যাবে না (Schizophrenia in bengali)। কিন্তু বিষয় হল, ওই ভুত যদি ঘাড়ে চেপে আমাদের বাড়ী ঘুরতে চলে আসে তাহলে? মাই গট! তবে এই ঘটনা নতুন নয় আগে একজন আসতো তার ছেলেকেও ভুতে ধরেছিল, মাঝে মাঝেই ৫০০ টাকা করে দিয়ে ভুত ছাড়াতে যেত কোনো এক ওঝার কাছে। হোম থেকে হরিনাম সব করেও তেমন লাভ হয়নি। মাঝে মাঝে আবার ঠাকুরের ভর হত, তবে কোন ঠাকুর তা নিশ্চিত ভাবে বোঝা যেত না। আর বোঝা যাবেই বা কি করে এ কি আর দু-একটা, একক-দশক-শতক-হাজার করে এক্কেবারে কোটি, তেত্রিশ কোটি!
ভারী অন্যায় (It’s not fair):
শহরের মানুষদের এটা খুব অন্যায় কাজ, ঠাকুরকে যখন ঘরের এক কোনে একটু জায়গা দিতে পেরেছে তখন ভুত দের চিলেকোঠাতে একটু ঠাই দিলেই হত, ওদের তো তেমন খাবার দাবারও লাগে না। এই জন্য কাতারে কাতারে ভুত সব গ্রামে, বস্তিতে চলে যাচ্ছে, আর লোকের ঘাড়ে চেপে বসছে। লোকের বাড়ী কাজ করে ১০০০ টাকা ইনকাম, তারপর যা বাজার দর, এখন ভুত ছাড়াতে যদি মাসে মাসে ৫০০ টাকা করে চলে যায় তাহলে কি করে চলে বলুন তো?
অনেকেই ভুতে বিশ্বাস করেন আবার অনেকেই করেন না। তবে আমি এমন অনেককে দেখেছি যারা ভুতে তেমন বিশ্বাস করেন না বা করলেও হয়তো আলো জ্বললে তা প্রকাশ করেন না অথচ ভর ওঠা, ঝোঁকা, গড়াগড়ি খেয়ে ভবিষ্যৎ বাতলে দেওয়া এগুলো বেশ ভালোই বিশ্বাস করেন। প্রশ্ন হল এগুলোর আদৌ কি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? উত্তর না। এই সবের জন্য দায়ী যে রোগ তার নাম সিজোফ্রেনিয়া (schizophrenia)। আজ এই নিয়েই কিছুটা আলোচনা করব।
আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) মানুষ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে অবস্থা জটিল বা গুরুতর হয় না। সিজোফ্রেনিয়াকে বলা হয় সাইকোলজিকাল ক্যান্সার। মুলত ওষুধ পত্র এবং বিহেভিয়ারাল থেরাপির মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। ১৫% ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়া ভাল হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগটি সম্পূর্ণ সারানো যায় না।
সিজোফ্রেনিয়া আসলে কি (What is Schizophrenia in bengali)?
১৮৮৭ সালে জার্মান মনোবিজ্ঞানী এমিল ক্রেপলিন প্রথম এই রোগের সন্ধান পান এবং এটিকে আচরণের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারপর ১৯১১ সালে ইউগেন ব্লেয়ার প্রথম সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) শব্দটি ব্যবহার করেন। সিজোফ্রেনিয়া হল এক ধরনের জটিল মানসিক রোগ। এই রোগটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে।
সিজোফ্রেনিয়া কেন হয় (Schizophrenia causes)?
সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia in bengali) মূলত দুই রকম কারনে হতে পারে বায়োলজি এবং পরিবেশগত। গবেষণায় দেখা গেছে এই রোগ সৃষ্টির জন্য আটটি জিন দায়ী। এই আটটি জিনের বিশৃঙ্খলতার কারণে সিজোফ্রেনিয়া হয়। সিজোফ্রেনিয়া হল ডোপামিন, গ্লুটামিন এবং নিউরোট্রান্সমিটারের মধ্যে একধরনের রাসায়নিক বিশৃঙ্খলতার ফল। বাবা এবং মায়ের মধ্য একজনের রোগটি থাকলে ১৭% সম্ভাবনা থাকে সন্তানের হওয়ার। আর দুজনের থাকলে সম্ভাবনা ৪৫%।
তবে এখন পর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে সিজোফ্রেনিয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশগত কারণ হল মুখ্য। একটি শিশু যে পরিবেশে বড় হয়, সেই পরিবেশের উপর নির্ভর করে শিশুটি সিজোফ্রেনিক হবে কিনা। যদি কোনো বিশেষ ঘটনা শিশুর মনের ভেতর তীব্র ছাপ ফেলে থাকে তাহলে পরবর্তী কালে এই রোগ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। সাধারনত ১৮ বছরে বয়সের পর এই রোগ প্রকাশ পায়, তবে অনেক ক্ষেত্রে ১৫ বছর বা তার আগেও এই রোগের প্রকাশ ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন- Food History & Culture: আহারের কতই না বাহার! জানুন বাঙালীর খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস
সিজোফ্রেনিয়ার রোগের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of schizophrenia):
হ্যালুসিনেশন (Hallucinations): অর্থাৎ যার কোন অস্তিত্ব নেই তা দেখা। এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক নিজের মতন একটি দৃশ্য তৈরি করে ফেলে, যা রোগীর বাস্তব মনে হয়। যেমন, ভুত দেখার মত ঘটনা! কিছু শব্দ শুনতে পাওয়া, যা সিজোফ্রেনিক ছাড়া আর কেও শুনতে পায় না। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে পিছনে কেও দাড়িয়ে আছে বা গুপ্তচরগিরি করছে।
ডিল্যুশন (Delusions): এতে রোগী মনে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস রাখে। যেমন অন্য জগৎ থেকে কেও তার সাথে কথা বলছে, সেটা প্রেতাত্মা হতে পারে বা ঠাকুর দেবতাও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সে নিজেকে ভগবানের এজেন্ট মনে করে।
অসংলগ্ন কথাবার্তা (Disorganized speech): এক্ষেত্রে রোগী এমন সব কথা বার্তা বলে যার অর্থ অন্য মানুষের কাছে সঠিক ভাবে প্রকাশ পায় না। অতীত, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলা এই রোগেরই একটি লক্ষন।
অদ্ভুত ব্যাবহার (Strange behavior): এ ধরনের রোগীরা ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে পছন্দ করে। অনেক সময় আবার ঘরে ফেরে না। গ্রামাঞ্চলে এই ঘটনা গুলিকে প্যারানরমাল একটিভিটি মনে করা হয়। বিভিন্ন প্রেত আত্মাকে এর জন্য দায়ী করা হয়। হাত পা ছোঁরা, ঝোঁকা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মনে করা হয় ঠাকুরের ভর হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে নার্ভের বিভিন্ন রোগের জন্য এমন হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ওই সময় কি ঘটেছিল পরে তা রোগীর মনে থাকে না।
একাকীত্বের জীবন বেছে নেওয়া (Withdrawn and lifeless): সিজোফ্রেনিক রা সমাজ জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না ফলে তারা একাকীত্বের জীবন বেছে নেয়। নিজের আবেগ সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে না। অনুভুতি এবং অনুপ্রেরনা কমে আসে, দৈনন্দিন কাজকর্মে আগ্রহের অভাব বোধ করে।
আরও পড়ুন- Earth day and climate change facts: হারিয়ে যাচ্ছে ছায়া ফেলা গাছেদের আশীর্বাদ
সিজোফ্রেনিয়ার প্রকারভেদ (Types of schizophrenia):
প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া (Paranoid schizophrenia): এটি সাধারণ সিজোফ্রেনিয়া। অন্য প্রকার গুলির তুলনায় এর লক্ষণ গুলি অনেক দেরিতে প্রকাশ পায়। এর মুল লক্ষণ হ্যালুসিনেশন, তবে এতে কথাবার্তা এবং আবেগ প্রভাবিত হওয়ার সম্ভবনা কম।
ক্যাটাটোনিক সিজোফ্রেনিয়া (Catatonic schizophrenia): এই ধরনের সিজোফ্রেনিয়া বিরল, তবে এর লক্ষন গুলি খুব অস্বাভাবিক এবং আকস্মিক। হঠাৎ করে রোগী খুব সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে বা একদম স্থির হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় অন্যের কথা ও গতিবিধি নকল করে।
হেবেফ্রেনিক সিজোফ্রেনিয়া (Hebephrenic schizophrenia): এটি ‘অসংগঠিত সিজোফ্রেনিয়া’ নামেও পরিচিত, এই ধরনের সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষন সাধারণত ১৫-২৫ বছর বয়সে মধ্যে বিকশিত হয়। স্বল্পস্থায়ী বিভ্রম এবং হ্যালুসিনেশনের পাশাপাশি অসংগঠিত আচরণ এই রোগ লক্ষনের অন্তর্ভুক্ত। অগোছালো কথাবার্তার ধরনের কারনে অন্যদের রোগীর মনের ভাব বুঝতে অসুবিধে হয়।
বিভেদহীন সিজোফ্রেনিয়া (Undifferentiated schizophrenia): এই ধরনের সিজোফ্রেনিয়াতে প্যারানয়েড, হেবেফ্রেনিক বা ক্যাটাটোনিক সিজোফ্রেনিয়ার কিছু লক্ষণ থাকতে পারে, তবে এটি স্পষ্টতই আলাদা, ওপরের কোনটির সাথে এটি খাপ খায় না।
সেনেস্টোপ্যাথিক সিজোফ্রেনিয়া (Cenesthopathic schizophrenia): সেনেস্টোপ্যাথিক সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা অস্বাভাবিক শারীরিক সংবেদন অনুভব করেন। কখনো মনে হয় তাদের শরীরে অন্য কেও প্রবেশ করেছে। বা অন্য কেও তাকে দিয়ে কোন কাজ করাচ্ছে।
এগুলি ছাড়াও আরও কয়েক ধরণের সিজোফ্রেনিয়া রয়েছে।
সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা (Treatment of schizophrenia):
আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামের দিকে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস অনুযায়ী ওঝা ডেকে ঝাড়ফুঁক এবং বিভিন্ন রিচুয়াল যেমন পুজো, যজ্ঞ ইতাদি করা হয় অনেকসময় সিজোফ্রেনিয়ার রোগীকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, তার ওপর চলে মারধোর, অত্যাচার। এতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়। অথচ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি তে সঠিক চিকিৎসা হলে রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভবনা থাকে। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন- Evolution of Musical Instruments: বান থেকে বীণা, হাড় থেকে বাঁশি, জানুন বাদ্যযন্ত্রের সেকাল-একাল
এই রোগের চিকিৎসা করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা (Psychiatrist), তাদের পরামর্শ অনুয়ায়ি ওষুধ পত্র এবং বিহেভিয়ারাল থেরাপির মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা হয়। এছারাও আমাদের দেশে অনেক হসপিটালে এই রোগের চিকিৎসা হয়। চেন্নাইয়ে সিজোফ্রেনিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশন (Schizophrenia Research Foundation, Chennai), এপোলো হসপিটাল (Apollo Multispecialty Hospitals, Mumbai, Delhi, Bangalore), মানিপাল হসপিটাল (Manipal Hospital, Bangalore), ফরটিস হসপিটাল (Fortis hospital, Mumbai) হরিজন লাইফ লাইন হসপিটাল, কলকাতা (Horizon life line Hospital, Entally, Kolkata) এগুলি ছাড়াও আরও আরও অনেক হসপিটাল আছে যেখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রা আপনাকে সঠিক পরামর্শ এবং চিকিৎসা দিতে পারবেন।
সব শেষে বলব এমন কিছু সিজোফ্রেনিকদের কথা যাদের নাম শুনলে আপনি হয়তো একটু অবাক হবেন। যদিও সাহিত্যে সিজোফ্রেনিয়া ঢুকেছে অনেকদিন আগেই। হুমায়ুন আহমেদ ‘আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি’ লিখেছিলেন এই রোগ কে উপজীব্য করে। আমেরিকার নোবেল জয়ী ম্যাথমেটিশিয়ান জন ন্যাশ ছিলেন সিজোফ্রেনিক। পরে তার বায়োগ্রাফি নিয়ে তৈরি সিনেমা একাডেমী পুরষ্কার পেয়েছিল। জ্যাজ মিউজিশিয়ান টম হ্যারেলও কিছুটা সিজোফ্রেনিক ছিলেন। এমন অনেক সাহিত্যিক, সংগীত শিল্পী, অভিনেতা আছেন যারা সিজোফ্রেনিক ছিলেন। এই রোগ কোনো বাধা নয়, এই রোগ থাকলেও সব রকম কাজ করা সম্ভব। কিন্তু প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হতে পারে।
লিখেছেন– এম.শুভম
তথ্য সুত্র-
*World health organization, who.int
*Mental health UK, mentalhealth-uk.org
*Cleveland Clinic, my.clevelandclinic.org
*Health line, healthline.com
*Web MD, webmd.com