Outlinebangla: কার্টুনের সঙ্গে পূর্ব যোগ রয়েছে বাংলার। ভারতের মধ্যে প্রথম কার্টুন সংস্কৃতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল আমাদের বাংলাতেই। ৬০-এর দশক থেকেই কার্টুন চরিত্রগুলোকে জীবিত করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এক কলেজ ছুট তরুন। ওই অল্প বয়সী তরুণের প্রচেষ্টাতেই কমিক পাঠের সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল গোটা বাঙালি সম্প্রদায়। আজ আপনাদের যে মানুষটির কথা বলতে চলেছি তিনি হলেন কমিক চরিত্রের প্রাণপুরুষ নারায়ণ দেবনাথ (Narayan Debnath)।
(Narayan Debnath) তাঁর তৈরি অনবদ্য কমিক চরিত্রগুলি হলোঃ
হাঁদা ভোঁদাঃ এই মজাদার কমিক চরিত্রের দুই তরুন খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যাদের নাম হাঁদা-ভোঁদা। এই কমিক মূলত ইস্ট -মোহনের লড়াই নিয়ে। সালটা ১৯৬২ এই জুটির কমিক স্টোরি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ছোটদের পত্রিকা শুকতারাতে প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো। তিনি চরিত্রদুটি কে বিশ্লেষণ করে একটি গল্পের রূপ দেন। এরপর সময়ের সাথে সাথে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায় এই হাঁদা -ভোঁদা কমিক স্টোরি।
আরও পড়ুনঃ Invention of the pen: পেন না থাকলে লিখতেন কিসে? জানেন কলমের ইতিহাস
বাঁটুল দি গ্রেটঃ ১৯৬২ সালে হাঁদা ভোদা কমিকস প্রকাশের পর, যখন কমিকস টি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, ঠিক সেই সময় স্বয়ং শুকতারার সম্পাদক তাকে আরেকটি কমিকস স্ট্রিপের দায়িত্ব নিতে বলেন। এর ফলে জন্ম নেয় ‘বাঁটুল দি গ্রেট।’ কলকাতার অলিতে গলিতে তখন মনোহর আইচ নামক এক ব্যায়ামবীর এর নাম শোনা যেত। তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের গোটা ভারতের মধ্যে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তার কথা মাথায় রেখে নারায়ন দেবনাথ (Narayan Debnath) বাঁটুল চরিত্রটিকে জীবন্ত করার চেষ্টা করেন। শুধুমাত্র স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পড়া বাঙালি প্রথম সুপার হিরো বাঁটুল, প্রায় শুরু থেকেই মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আসছে। বাঁটুল দি গ্রেট ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে (১৯৬৫ সাল থেকে) শুকতারায় প্রকাশিত হয়ে আসছে।
আরও পড়ুনঃ Hatshepsut ruled Egypt in the guise of a man: নারী হয়েও পুরুষের বেশে মিশর শাসন করেছেন হাতশেপসুত
নন্টে-ফন্টেঃ বাংলা ভাষার একটি জনপ্রিয় কৌতুক কমিকস হলো নন্টে-ফন্টে ও হাঁদা-ভোঁদা নন্টে-ফন্টের মতো দুটি কমিকস পরপর প্রকাশের পর কমিকসের চাহিদা মানুষের কাছে ক্রমশ বেড়ে চলেছিল। শেষমেষ একরকম বাধ্য হয়েই ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকা,প্রকাশকের অনুরোধে নারায়ণ দেবনাথ পুনরায় ১৯৬৯ সালে আরেকে কিশোর জুটি নন্টে – ফন্টে তৈরি করেন।বোর্ডিং স্কুলের নন্টে- ফন্টের দাপাদাপি থেকে শুরু করে কেল্টু দার কীর্তি এবং সুপারিটেনডেন্ট এর শাসন পর্যন্ত সব মিশিয়ে সমস্ত তরুণ সম্প্রদায়কে নাড়িয়ে দিয়েছিল এই কমিকস। ২০০৩ সালে থেকে এটির রঙিন সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমানে আকাশ আট নামক চ্যানেলে এই কমিক একটি অ্যানিমেটেড ভিডিও সিরিজে দেখানো হয়।
বাহাদুর বিড়ালঃ ১৯৮২ সালে সাধারণত কিশোর ও শিশুদের কথা ভেবেই নারায়ন দেবনাথ ‘বাহাদুর বিড়াল’ চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন, তবে এখানে বাহাদুর কোন মানুষ নয়, কুবুদ্ধিতে অদ্বিতীয় বাহাদুর একটি বিড়াল। বুদ্ধির জেরে নিজের ভুলভাল কাজের জন্য নিজেই বিপদে পড়ত। বুদ্ধিমান কুকুর নামক একটি চরিত্রে উল্লেখ আছে কমিকসে।
আরও পড়ুনঃ Schizophrenia: ভূত এবং ভগবানের আসল রহস্য
ইন্দ্রজিত ও ব্ল্যাক ডায়মন্ডঃ এই কমিক্স এর গল্প তৈরি করেন দিলীপ চট্টোপাধ্যায়। তবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত অলংকরণের দায়িত্বে ছিলেন নারায়ন দেবনাথ তার ছোঁয়াতেই চরিত্রগুলি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। ইন্দ্রজিৎ এই কমিকসে একজন ধুরন্ধর গোয়েন্দা। ইন্দ্রজিতের বেশ কিছু কমিকস পরবর্তীকালে ‘কিশোর ভারতি ‘পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
কমিকসে বাঙালিয়ানা
গোয়েন্দা কৌশিকঃ ধুন্ধুমার ফাইটিং হোক বা ক্ষুরধার বুদ্ধি যেকোনো দিকেই গোয়েন্দা কৌশিকের জুড়ি মেলা ভার। কোন তদন্তে হাত লাগালে তার শেষ দেখেই তবেই ছাড়তেন তিনি। দুষ্কৃতিদের তার দৃষ্টি এড়ানো অসম্ভব বললেই চলে। এই কমিক চরিত্রের জন্মদাতা হলে নারায়ন দেবনাথ। বাংলা কমিকসে এরকম বক্সিং এ সিদ্ধ হস্ত, মার্শালআর্ট জানা তুখোড় ডিটেকটিভ খুব কমই রয়েছে।
শুটকি আর মুটকিঃ হাঁদা-ভোঁদা নন্টে ফন্টের মত শুটকি আর মুটকি আর এক মানিকজোড়। তাদের মজার কান্ড কারখানা নিয়ে তৈরি এই কমিক্স ১৯৬৪ সালে দেবসাহিত্য কুটিরের শুকতারা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট প্রথম মহিলা কমিক্স। মহিলা মহলে বিতর্ক উঠায় কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পর এই কমিক্স এর পথ চলা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়।
ডানপিটে খাদু আর তার কেমিক্যাল দাদুঃ ‘ছোটদের আসর’ নামক একটি পত্রিকাতে ১৯৮৩ সাল থেকে এই কমিকস এর আত্মপ্রকাশ। শুভ্রা এবং সহ সম্পাদিকা বেবি মজুমদারের অনুরোধে নারায়ন দেবনাথ এই কমিকস গল্পটি শুরু করেন, কিন্তু দেড় বছর পর বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় এক বছর পর ১৯৮৪ সালে গ্রন্থ আকারে ‘গোল্ডেন কমিকস ‘থেকে প্রকাশিত হতো।
পটল চাঁদ দা ম্যাজিসিয়ানঃ ১৯৬৯ সালে প্রথম ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকা থেকে কমিকস টির পথ চলা শুরু হয়, কিন্তু এক সংখ্যা প্রকাশের পর পটলচাঁদ কমিকস বন্ধ হয়ে যায়। তবে এটি পথ চলা থেমে থাকে নি। পরে ‘পক্ষীরাজ ‘এবং ‘হরেকরকম’ নামক পত্রিকা গুলোতে নিয়মিতভাবে এই কমিকস প্রকাশ করা হতো।
পেটুক মাস্টার বটুক লালঃ এই কমিকস এ বটুক লাল হলেন একজন স্কুল শিক্ষক। যিনি খেতে খুব ভালোবাসেন। খাবারের গন্ধ পেলে নিজেকে আর সামলাতে পারেন না সমস্ত কিছু ভুলে খাবার চুরির সুযোগ খুঁজে বেড়াই আর প্রত্যেকবারই সেই সমস্ত পরিচালনা বানচাল করে দেয় তার ছাত্ররা ‘কিশোর মন ‘নামক পাক্ষিক পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এই কমিকস চরিত্র।
শিশু সাহিত্যিক
নারায়ণ দেবনাথ নিজেকে কার্টুনিস্ট বা কমিকস আর্টিস্ট বলার চেয়ে শিশু সাহিত্যিক হিসেবেই সর্বক্ষেত্রে পরিচয় দিতেন। কারণটা হল তিনি তো শুধু আঁকেনই নি, গল্প লিখেছেনও। বরং বলা যায়, একই সাথে গল্প লেখা ও আঁকার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন দীর্ঘদিন। ফলে সাহিত্যাঙ্গনে তার অবদান যে কোনো অংশে কম নয়।