Outlinebangla: চিরকাল বাঙালিদের মধ্যে খাবার দাবারকে নিয়ে এক আলাদা অনুভূতি রয়েছে। নিয়মিত খাদ্যভাস থেকে শুরু করে পাল পার্বন পর্যন্ত নানান বাহারি পদে থালা সাজাতে পেলে বাঙালি আর কিছুই চাই না। সময়ের স্রোতে বাঙালিদের খাদ্যতালিকায় নানান পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে খাদ্যতালিকার বদল ঘটলেও স্বাদ কিন্তু পাল্টে যায়নি। ভালো সুস্বাদু খবর মানেই বাঙালি খাবার। এ যেন বাঙালীদের ট্যাগে রূপান্তরিত হয়েছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যেমন বাঙালির থালায় যুক্ত হয়েছে একাধিক পদ, ঠিক তেমন করেও লুপ্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন পদ (Food History & Culture)। তাই আজ আমরা জানবো বাঙালির খাদ্যভাসের ইতিহাস সম্পর্কে (Food History & Culture)।
বাঙালির খাদ্যভাসের ইতিহাসঃ
বহুকাল আগে আদিম মানুষেরা যখন জঙ্গলে বসবাস করতো তখন খাবার সংগ্রহ করা থেকে খাবার উৎপাদন করার সময়েই মানুষের খাদ্যভাসে নানান বাহার এসেছিলো। প্রথমদিকে এরা কাঁচা মাংস, কাঁচা শাকসবজি, কাঁচা ফলমূল খেত। তারপর পোড়াতে, জলে সেদ্ধ করতে একসময় তেলে ভাজতেও শিখে গেলো। তবে খাবারের বাহারের পিছনে রীতিনীতি, পরম্পরা খাবারের সহজলভ্যতা, ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত নানান প্রভাব দায়ী। এই যেমন ধরুন আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আমিষ খান আবার অনেকেই নিরামিষ খান পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায় অনুযায়ী মাংস খাওয়ার রুচিগত পার্থক্য চোখে পড়ার মতো।
আরও পড়ুনঃ Puchka: বলুন তো, কার হতে ধরে আবিষ্কার হয়েছিল ফুচকা? জানুন এই সুস্বাদু পদের ইতিহাস..
প্রাচিন বঙ্গে খাদ্যভাসঃ
লেখক প্লিনি ও পেরিপ্লাসের বইগুলোতে বিভিন্ন ধরণের সুগন্ধি ও মশলার কথার উল্লেখ রয়েছে। গ্রিক ও রোমানরা যখন আমাদের দেশে এসেছিলো তখন এদেশে ধান, গম, যব, সর্ষে, কলায়ের পাশাপাশি নারকেলও চাষবাস হতো। এছাড়াও বিখ্যাত কাব্যে অন্নদামঙ্গলে ভারতচন্দ্র ব্রাহ্মণ ভোজনের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে নিরামিষ আমিষ থেকে শুরু করে তেতো-কষাটে, টক-মিষ্টি কোনো খাবারের কমতি নেই।
মধ্যযুগে বঙ্গে খাদ্যভাসঃ
এই যুগে বাঙালির খাদ্যভাসে ইন্দো-পারসিক রুচির প্রচলন ঘটেছিলো। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে মৎস্য ভোজনের বিপুল বর্ণনা রয়েছে। যে পদ গুলিতে রুই, কাতলা, চিতল, মাগুর, চিংড়ি, পাবদা, শোল ইত্যাদি মাছের নাম আছে। জানা যায় প্রাচীনকাল থেকেই শুঁটকি মাছ বাঙালির কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এছাড়াও ষোড়শ শতকে বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে মাছ রান্নার বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ History of cookies and biscuit: কোথা থেকে এলো কুকিস বা বিস্কুট! জানেন কি
উপনিবেশিক পর্বে বঙ্গে খাদ্যভাসঃ
আমরা সকালে উঠে ব্রেকফাস্টে যে বিস্কুট, পাউরুটি খেয়ে থাকি এমনকি চা খাওয়ার অভ্যাসের প্রচলন শুরু হয়েছিল এই যুগে বিদেশিদের হাত ধরে। পর্তুগীজরা আমাদের শুধু আলু খাওয়া শেখায়নি, দুধ কাটিয়ে ছানা বানিয়ে তারপর সেটা থেকে কি করে সন্দেশ ও মিষ্টি বানানো হয় সেটাও শিখিয়েছিলেন। বর্তমান হুগলি জেলায় মিষ্টি তৈরিতে প্রথম ছানা ব্যবহার করেছিলেন এই পর্তুগীজরায়।
উনিশ শতকে বাঙালির খাদ্যভাসে পরিবর্তনঃ
চলুন এবার আমরা জেনে নেবো উনিশ শতকের খাদ্যভাসের ইতিহাস নিয়ে। এইসময়েই বাঙালির রান্নার রেসিপি এবং খাবারের প্রণালীকে ঘিরে প্রথমবার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। রন্ধন চর্চা নিয়ে তৎকালীন নানান সাময়িক পত্রে লেখালিখি চলতো। ১৮৩১ সালে প্রকাশিত বিশ্বেশ্বর তর্কালংকার ভট্টাচার্যের লেখা ‘পাক রাজেশ্বর’ এবং ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গৌরীশঙ্কর তর্কবাগিশের রচিত ‘ব্যাঞ্জন রত্নাকর’ মাতৃভাষায় প্রকাশিত প্রথম রান্নার দুটি বই। তবে বিপ্রদাস রচিত পাক- প্রণালি বইটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছিল। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে বাঙালি গৃহবধূদেরও বই লিখতে আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। ‘রকমারি নিরামিষ রান্না’ আর ‘আমিষ খন্ড’ লেখেন রেণুকাদেবী চৌধুরানী নামক একজন ভদ্রমহিলা। এছাড়াও ‘বরেন্দ্র রন্ধন’ নামের রান্নার বইটি লেখেন কিরনরেখা রায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ভাত্রুসপুত্রি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী এবং পুন্য পত্রিকার সম্পাদিকা মিলিতভাবে ‘আমিষ-নিরামিষ’ বইটি লেখেন।
আরও পড়ুনঃ Know the exciting facts about egg roll: জানেন কি সুস্বাদু এগ রোলের জন্ম রহস্য?
কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে উপরের উল্লিখিত সমস্ত বই গুলোর মধ্যে নিরামিষ রান্না তো আছেই তার সঙ্গে মাংসের মতো বিভিন্ন বাহারি আমিষ রান্নার রেসিপিও রয়েছে। তবে একদিন অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকেরা এই মাংসপ্রিয় বাঙালিদেরই ‘ভীতু ও ভীরু’ বলে উপহাস করতেন। কারণ এই সময়ে কে নিরামিষ কে আমিষ এই নিয়ে বাঙালি এবং ভারত সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করা হতো অর্থাৎ ব্যাপারটি এরকম পাশ্চাত্য হলো আমিষ আহার মানে বন্য এবং হিংস্র অপরদিকে প্রাচ্য বলতে নিরামিষ আহারকে বোঝাচ্ছে যেটা সত্য এবং শান্ত। এইসময় জেগে ওঠা জাতীয়তাবাদের উত্থানের সাথে তাল মিলিয়ে বহু মানুষের আমিষ খাদ্য গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। শরীর গঠনে এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে মাংস খাওয়ার উপর জোর দিয়েছিলেন রাজনারায়ণ বসু। উল্টোদিকে উনিশ শতকের সাময়িক পত্রিকাগুলোতে বাঙালি গৃহবধূদের অন্দরে ঢুকে তাদেরকে রান্নাঘর এবং তাদের হাতের রান্নাকে মূল কেন্দ্রবিন্দু করে তৎকালীন পারবারিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা চালু করেছিল। সেই সময়ে সুগৃহিনী প্রমাণিত হতো হাতের সুস্বাদু রন্ধনের দ্বারা।