সেকালের সবথেকে বড় পন্ডিত যিনি, তিনি বই লিখছেন নিম্ন মেধার ছাত্র দের জন্য। সমসাময়িক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায় সেই সময় দাঁড়িয়ে এই মানুষটিকে কত বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
—লিখেছেন- এম. শুভম
দানের সাগর রূপে বহুল চর্চিত একজন ব্যক্তিত্ব ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, কিন্তু এই সমস্ত ভাসা-ভাসা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বশবর্তী হয়ে আসল মানুষটিকে আমাদের চিনে ওঠা হয় না। বিদ্যাসাগরের চরিত্রের গভীরতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাহার অজেয় পৌরুষ, তাহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব”। রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্লেষণ বিদ্যাসাগর চর্চার ধারণার কিছুটা পরিবর্তন ঘটালেও সমকালীন বেশিরভাগ লেখক বা কবি তার প্রতি কোনরকম কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেননি।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখায় বিদ্যাসাগর এর প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথের উপর বিদ্যাসাগরের প্রভাব বিশ্বকবি নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তখন কবির বয়স ৭৮ বছর। তিনি গেলেন মেদিনীপুর, বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বার উদঘাটন করতে। সেখানে গিয়ে বললেন, “বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদঘাটন করেছেন বিদ্যাসাগর”।
২৯ শে জুলাই ১৮৯১ সাল, প্রয়াত হলেন বিদ্যাসাগর। সেই বছরই রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’ এর মত ছোট ছোট গল্প গুলি প্রকাশিত হচ্ছে। সমাজের নারী জাতির উপর বিভিন্ন নিপীড়নের কথা সাহিত্যের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরছেন। সেই সময় প্রয়াণের খবর। শ্রদ্ধাঞ্জলি রুপে ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশ করা হলো ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ লিখলেন রবীন্দ্রনাথ।
পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হয়েছেন শুনে তিনি বললেন আমি তাহাদের সুখের কোনো ব্যাঘাত ঘটায় নাই-
বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি নিয়ে সমাজে অনেক প্রচলিত ধারণা আছে। বর্ষাকালে সাঁতারে দামোদর পার হওয়ার গল্প, আরো কত কি। যখন তিনি বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়নের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন ঠিক সেই সময় ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যাসাগর কে চিঠিতে লিখছেন, “পিতা-মাতা অসন্তুষ্ট হয়েছেন”। ঈশ্বর প্রত্যুত্তরে লিখলেন, “আমি জ্ঞানত তাহাদের সুখের কোনো ব্যাঘাত ঘটায় নাই, তাহারা কেন আমার সুখ প্রদায়ক কর্মের ব্যাঘাত হইবেন?” অবশ্য এর আগেও তিনি বলেছিলেন, “আমি দেশাচারের দাস নই, যা কর্তব্য মনে করি তা পালন করার জন্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতেও পিছিয়ে যাবো না”
তিনি বাল্যবিবাহকে অন্তর থেকে ঘৃণা করতেন, কারণ বাল্যবিবাহের পরিণতির কথা তার জানা ছিল। বালবিধবাদের প্রতি তিনি অন্তর থেকে ব্যথা অনুভব করতেন। সে সময় তার সমালোচক বা নিন্দুক কম ছিল না। তিনি জীবনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন শত নিন্দা শুনলেও তিনি কারো বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা বাক্য প্রয়োগ করবেন না। একথা খানা তিনি তার জীবনকালে রক্ষা করেছিলেন। তৎকালীন সমাজের কত প্রগতিশীলরা, বলা উচিৎ বাতেলাবাজ প্রগতিশীলরা বিধবা বিবাহ করবেন বলে তার কাছ থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। টাকা-পয়সা নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু সময় এলে তারা পিছিয়ে গিয়েছেন বিবাহ করেননি, তা বলে টাকা পয়সা ফেরত দেননি।
বর্ণপরিচয় দিয়ে শুরু। তারপর সংস্কৃত শিক্ষার উপযোগী বিভিন্ন গ্রন্থ প্রণয়ন। গ্রীষ্মাবকাস প্রথার প্রবর্তন। সংস্কৃতর সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ইত্যাদি বহু বিষয়ে তিনি তার জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়েছিলেন। সেই সময় অচলায়তনের দরজা একদম ভেঙে দিতে না পারলেও তিনি তাতে বেশ বড় বড় কিছু ছিদ্র করেছিলেন যা আর মেরামত করা সম্ভব হয়নি। তারই সুফল ভোগ করছি আমরা।
বিদ্যাসাগরকে সরকার সি.আই.ই (CIE) দিতে চাইলে তা এড়াতে তিনি কিছুদিন কলকাতার বাইরে গিয়ে ছিলেন-
অনেকেই বিদ্যাসাগরের ইংরেজপ্রীতির প্রমাণ খুঁজে বেড়ান। বলা যায় তার ত্রূটি খোঁজার চেষ্টা করেন। অবশ্য গুন আয়ত্ত করার থেকে ত্রূটি খোঁজা অধিক সহজ। তখন সুট বুট পড়ে লাটসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার রীতি ছিল। তিনি তো সুট বুট পরতেন না, ফলে প্রহরীরা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এরপর বাঙালি পোশাক পড়ে যাওয়া যাবে এই সংবাদ একাধিকবার তাকে পাঠানো হলেও তিনি আর ওমুখো হননি। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাঘরে চটি পরে যাওয়া যাবে না বলে সেখানে আর কোনদিন তিনি পা রাখেননি। বিদ্যাসাগরকে সরকার সি.আই.ই (CIE) দিতে চাইলে তা এড়াতে তিনি কিছুদিন কলকাতার বাইরে গিয়ে ছিলেন। তারপর যখন বাড়ি ফিরলেন, রাজকর্মচারীরা বাড়ি বয়ে এসে পদক দিয়ে গেল, পরিবর্তে বকশিস চাওয়ায় বিদ্যাসাগর বললেন, “ওই পদক বেনের দোকানে বেচে যা পাবে নিয়ে নাও।“
১৯২২ সালের ২ রা আগস্ট কলকাতায় ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ এর দ্বারা আয়োজিত হয় বিদ্যাসাগর স্মরণসভা। সেখানে সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ। পরে সেই আলোচনা ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “প্রতিবছর স্মরণসভায় বক্তারা তার দানশীলতা নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু তিনি তৎকালীন সমাজের রক্ষণশীলতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে লড়াই করেছিলেন তা চাপা পড়ে থাকে”। বিশ্বকবি চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের চরিত্রের পরিচয় দেশের মানুষের কাছে পৌঁছাক। ১৮৯৮ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় আরো একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে তিনি বিদ্যাসাগরের চিন্তা-চেতনা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না। তিনি দ্বিগুণ জীবিত ছিলেন।“
এরকম আরও কত ঘটনা আছে, মানুষ হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন সে কথা বুঝতে গেলে দানের সাগর বা দয়ার সাগরের ন্যায় ক্ষুদ্র পরিসরে তাকে আটকে রাখলে চলবে না। সেই সময় দাঁড়িয়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে, নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে তিনি সমস্ত কাজ কর্ম করেছিলেন সেগুলি আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। তবেই তাঁর চিন্তাধারার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।